রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে আত্মতৃপ্তির পাশাপাশি মনঃকষ্টেও ভুগতেন সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি বলেছেন, ‘আমি দেশবাসীর প্রতি কৃতজ...
রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে আত্মতৃপ্তির পাশাপাশি মনঃকষ্টেও ভুগতেন সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তিনি বলেছেন, ‘আমি দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ। তাঁরা আমাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন। আমিও তাঁদের উন্নয়ন এবং কল্যাণে কাজ করার চেষ্টা করেছি।’ এখন তাঁর প্রত্যাশা, নতুন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিনও দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করবেন।
নিজের অতৃপ্তি-কষ্টের কথা বলতে গিয়ে মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী এমপিদের ৫১ শতাংশই ছিলেন অ্যাডভোকেট। এর পরেই অবস্থান ছিল কলেজ-হাই স্কুলের শিক্ষক ও সার্বক্ষণিক রাজনীতিকদের। ব্যবসায়ী ছিলেন শতকরা ২ থেকে ৩ শতাংশ। আর এখন? ৬২ শতাংশই ব্যবসায়ী। এই পরিসংখ্যান অবশ্যই যন্ত্রণা দেয়।
রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে পর্যায়ক্রমে ডেপুটি স্পিকার, বিরোধীদলীয় উপনেতা, স্পিকার ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করে আসা মো. আবদুল হামিদ বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের কৌশল বাতলে দিয়েছেন। স্পষ্ট বলেছেন, রাজনীতিতে যে কোনো সমস্যার সমাধান হতে হবে আলোচনার মাধ্যমে। সমস্যা আছে মনে করলে সংলাপের বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে আন্তরিক হয়ে সংলাপ করতে হবে।
সেটা না হলে পারস্পরিক ঝগড়া-ফ্যাসাদ ছাড়া কিছুই হবে না। আর আলোচনা হলে সমাধানও আসবে।
একটানা দুই মেয়াদে ১০ বছরের বেশি সময় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শেষে গত সোমবার বঙ্গভবন থেকে বিদায় নেন মো. আবদুল হামিদ। এর আগে গত শুক্রবার তাঁর সরকারি বাসভবন বঙ্গভবনে সমকালের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে রাজনীতির চলমান সংকটসহ সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন। রাজনীতিবিদদের পরামর্শ দিয়েছেন। আন্তরিক পরিবেশে নানা বিষয়ে বেশ খোলামেলা কথা বলেছেন।
ষড়যন্ত্র হতে পারে
সাক্ষাৎকারে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে কথা বলেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ। তিনি বলেছেন, সরকার সংবিধানের ভেতরে থেকেই নির্বাচন করতে চাইছে। এর বাইরে তারা যাবে না। আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাইছে বিএনপি। এ ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবে না বলেও জানিয়েছে। সুতরাং সংকট তো আছেই। কেউ কেউ নির্বাচনে আসতে পারে, আবার কেউ কেউ নির্বাচনে নাও আসতে পারে। ষড়যন্ত্রও হতে পারে।
বর্তমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে মধ্যস্থতার জন্য আহ্বান করা হলে আসবেন কিনা? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, সে ধরনের প্রস্তাব এখনও আসেনি। তবে সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচনের গ্যারান্টি দিলে বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে, তা হলে বুঝতে হবে তাদের অন্য উদ্দেশ্য আছে। আবার সরকার যদি নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা না করে, তা হলে বুঝতে হবে তাদেরও অন্য উদ্দেশ্য রয়েছে। এমন উদ্দেশ্য কারোরই থাকা উচিত নয়। সবাইকে ছাড় দিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
পরদেশ-নির্ভরতায় অসন্তুষ্টি
রাজনীতি নিয়ে পরদেশ-নির্ভরতায় খুবই অসন্তুষ্ট সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। তাঁর মূল্যায়ন, এই মানসিকতা স্পষ্টতই দেউলিয়াপনা। এই মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে চীন-রাশিয়াসহ দুনিয়ার সব রাষ্ট্রকে ডেকে আনলেও সমস্যার সমধান হবে না। আমেরিকা ও ইউরোপ কি তাদের সমস্যার সমাধান করতে মধ্যস্থতার জন্য কাউকে ডাকে? তাহলে আমরা কেন ডাকব? এ ধরনের সহযোগিতা প্রত্যাশা করাটা কোনো দলের জন্যই ঠিক না।
সবাই এমপি হতে চান
জাতীয় সংসদে তাঁর সর্বশেষ ভাষণের প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেছেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার নেতা। বঙ্গবন্ধুর উদ্ধৃতি দিয়ে আমি সংসদে কথা বলেছি। আমি কী চাই– সেটা বলার চেষ্টা করেছি। সংসদে এমপিদের পেশাগত পরিচয়ের পরিসংখ্যান যন্ত্রণা দেয় আমাকে।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী? আবদুল হামিদের ঝটপট জবাব, যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁদের এগিয়ে আনতে হবে। পরিচ্ছন্ন ও ভালো মানুষকে রাজনীতিতে আনতে হবে। তাঁরাই এমপি হবেন। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার, এখন সবাই এমপি হতে চান। সচিব ও সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা অবসরে গিয়ে এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তাঁদের কেন এমপি হতে হবে? আর তাঁরাই যদি এমপি হন, তাহলে যাঁরা মাঠ পর্যায়ে রাজনীতি করেন, তাঁরা পাবেনটা কী?
১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনয়ন প্রক্রিয়া
রাজনীতির বাইরের মানুষকে কেন মনোনয়ন দেন রাজনীতিকরা? এ প্রশ্নের উত্তরে আবদুল হামিদ ১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনয়ন প্রক্রিয়ার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের মনোনয়ন দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু এতে কী হলো? খালেদা জিয়া কিন্তু তা করেননি। তিনি বড় বড় জেনারেল, সচিব ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের মনোনয়ন দেন। এটাই তাঁর ক্ষমতায় আসার একমাত্র কারণ। আর বিরোধী দলে যান শেখ হাসিনা। তিনি (শেখ হাসিনা) পরে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের বেলায় দেখলেন, তিনিও ওই রকম সিদ্ধান্ত না নিলে বিরোধী দলেই থাকবেন। তাঁকে আর ক্ষমতায় যেতে হবে না।
মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘ক্ষমতায় যেতেই হবে’– এ মানসিকতা বর্জন করতে হবে সব রাজনৈতিক দলকে। ভালো মানুষ নিয়ে রাজনীতি ও নির্বাচন করতে হবে। জনগণ ভোট দিলে ক্ষমতায় যাওয়া যাবে, নইলে ক্ষমতায় যাওয়া যাবে না– এটা সব রাজনৈতিক দলের বিশ্বাসে থাকলে রাজনীতি সমান গতিতে চলবে। তা ছাড়া এর কোনো বিকল্পও নেই। এই চেতনা সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে থাকতে হবে।
সিনহার পদত্যাগ ও খালেদার সন্তুষ্টি
রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে সিদ্ধান্ত দেওয়ার বেলায় কঠিন ও জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার কথা অবলীলায় বলেছেন সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি। তাঁর ভাষায়, কঠিন ও জটিল পরিস্থিতি যে আসেনি, তা নয়। মনের বিরুদ্ধে দু-একটি কাজও হয়েছে। এটা হতেই পারে। সেটা বেশি হয়নি। তিনি সেই পরিস্থিতিকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন; সুন্দর ও সহজভাবে সামাল দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি উদাহরণ দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার পদত্যাগের বিষয়টি। তাঁর দৃষ্টিতে, ওই বিষয়টি সামাল দেওয়াটা ছিল খুবই কঠিন। কিন্তু তিনি চমৎকার কৌশলে ওই পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন। যার ফলে এস কে সিনহাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। এমনই আরেকটি ঘটনা ২০১৪ সালের নির্বাচনের কিছুদিন আগের। ওই সময়ে বিএনপির তৎকালীন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বেশ কয়েকটি কঠিন প্রসঙ্গ নিয়ে বঙ্গভবনে এসেছিলেন। কিন্তু শেষতক তিনি বঙ্গভবন থেকে অসন্তুষ্ট হয়ে যাননি বলে মন্তব্য করেছেন সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি।
রাষ্ট্রপতি হতে চাইনি
কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হাওরের মুক্ত পরিবেশে বেড়ে ওঠা আবদুল হামিদ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ২৫ বছর বয়সে জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর স্বাধীন দেশে আরও সাতবার ভোটে জিতে তাঁর প্রতি আস্থা-বিশ্বাস আর ভালোবাসার প্রমাণ দেন। তাঁর বক্তব্য, সংসদেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তিনি রাষ্ট্রপতি হতে চাননি। তাঁর রাষ্ট্রপতি হওয়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাষ্ট্রপতি হতে হয়েছে।
কিশোরগঞ্জে আমি ছিলাম সুপ্রিম কমান্ডার
রাজনৈতিক জীবনের শুরুর দিকে মোঃ আবদুল হামিদের পদচারণা ছিল কিশোরগঞ্জকেন্দ্রিক। ১৯৯৬ সালে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার আগপর্যন্ত কিশোরগঞ্জে রাজনীতি করেছেন। ওকালতি করায় তখন কিশোরগঞ্জের বাইরে আসার পরিস্থিতি ছিল না তাঁর। তা ছাড়া ঢাকার রাজনীতি ও নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করাটাও খুব একটা ভালো লাগত না। তাঁর ভাষায়, ‘কিশোরগঞ্জে আমি ছিলাম সুপ্রিম কমান্ডার। সেখানে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, আমি কিশোরগঞ্জের সব দল চালাতাম আমার মতো করে।’
অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘আমি রাজনীতি করেছি দেশের উন্নতির জন্য; মানুষের কল্যাণের জন্য। আমার দল যখন সরকারে ছিল, তখনও আমি ব্যাংক-পারমিটের রাজনীতি করিনি। কখনোই ব্যক্তির জন্য কিছু চাইনি। কিশোরগঞ্জ ছিল আমার রাজনীতির চারণভূমি। একসময়ে আমার হাওর এলাকা ছিল খুবই অবহেলিত। আমি সেই হাওর এলাকার উন্নয়নের জন্য কিছু কাজ করার চেষ্টা করেছি। তবে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারিনি।’
বন্দিজীবন
রাষ্ট্রপতির জীবনযাপনকে এক ধরনের বন্দিজীবনের সঙ্গে তুলনা করেছেন আবদুল হামিদ। তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তানের জেলে বন্দি ছিলাম। জিয়ার শাসনামলেও গ্রেপ্তার হয়েছি। রাষ্ট্রপতির জীবনটাও অনেকটা ওই বন্দিদশার মতো। পার্থক্যটা হলো, রাষ্ট্রপতির জীবনে শান-শওকত আছে। স্যালুট পাওয়া যায়। মানে একটা পোসপাস আছে। জেলে পোসপাস নেই। এ ছাড়া কারাগারের সঙ্গে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এটাই তো বন্দিজীবন।’
এ ক্ষেত্রে তিনি অবশ্য কিছুটা হলেও বৈরী পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটিয়েছেন। তিনি প্রায় প্রতিদিনই রাত ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত বঙ্গভবনে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে গল্প-গুজব করতেন। তাঁর ভাষায়, ‘এটা নজিরবিহীন। তাঁর দায়িত্ব পালনকালে যে সংখ্যক দর্শনার্থী বঙ্গভবনে এসেছেন, সেটা অন্য সব রাষ্ট্রপতির (বঙ্গবন্ধু ছাড়া; তিনি অতুলনীয়) মেয়াদকালে মিলিয়ে যোগ করা হলে তা চার ভাগের এক ভাগও হবে কিনা সন্দেহ।’
ব্যক্তির জন্য সংবিধানে পরিবর্তন আনা ঠিক না
বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে আবদুল হামিদের মতো এত দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের রেকর্ড কারও নেই। আর সংবিধান অনুযায়ী, দুই মেয়াদের বেশি কারও রাষ্ট্রপতি থাকার সুযোগ নেই। এ জন্য আবদুল হামিদকে আরেক দফায় রাষ্ট্রপতি করার জন্য সংবিধানে পরিবর্তন এনে তিন মেয়াদের বিধান সংযোজনের গুঞ্জন ছিল।
এ প্রসঙ্গে সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী একজন ব্যক্তির দুই দফায় রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাই অনেক এমপি একজন ব্যক্তির তিনবার রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য সংবিধান সংশোধনের কথা বলেছিলেন। সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর রয়েছে এক নম্বরে। আমার স্বাক্ষর ৭১ নম্বরে। আমি বলেছি, যে সংবিধান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে করেছি, সেই সংবিধান সংশোধন করে আরেক টার্ম রাষ্ট্রপতি থাকব– এটা হয় না। তাই এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন বোধ করি না। ব্যক্তির জন্য সংবিধানে পরিবর্তন আনাটা কোনোভাবেই ঠিক না। তা ছাড়া আমার ওই ইচ্ছাও ছিল না।’
অন্য পদে যাব না
মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘আমি মনে করি, দেশবাসীর দোয়ায় ইজ্জতের সঙ্গে যেতে পারছি। এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন। এর বাইরে আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। এখন আমি অবসরজীবন কাটাব। সুযোগ দিলেও অন্য কোনো পদে যাব না। এটা আমি কখনোই করব না। রাষ্ট্রপতি পদের ওপরে আর কোনো পদ নেই। মানুষ আমাকে এত ওপরে বসিয়েছে, এর নিচের কোনো পদে গেলে জনগণকে অপমান করা হবে। তা ছাড়া আমার এমন ধরনের কোনো খায়েশও নেই। তাই যে ক’দিন বাঁচি, সাধারণ জীবনই কাটাব। ঢাকায় থাকব। কিশোরগঞ্জে থাকব।’
মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন জিয়া, এরশাদ
জিয়াউর রহমান ও এইচ এম এরশাদ মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন আবদুল হামিদকে। ওই প্রস্তাবে তিনি ইতিবাচক সাড়া দেননি। তবে কয়েক দফায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁকে শুনতে হয়েছে, ‘আপনার দল কখনোই ক্ষমতায় যেতে পারবে না। আপনিও মন্ত্রী হতে পারবেন না। শুধু এমপি হয়েই থাকতে হবে। সুতরাং আমাদের দলে আসুন। মন্ত্রী বানাব।’ কিশোরগঞ্জের বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা তাঁকে বলতেন, ‘আপনি মন্ত্রী হলে আমাদের প্রভাব থাকত। আমরা বলতে পারতাম, মন্ত্রী আমাদের খাতিরের মানুষ; কিন্তু নিজের অবস্থানে অনড় থেকেছেন আবদুল হামিদ। নীতি-আদর্শে অবিচল থেকেছেন। মন্ত্রিত্বের প্রস্তাবকারীদের বলেছেন, তিনি নীতি নিয়ে থাকতে চান। কখনোই নীতির সঙ্গে আপস করবেন না।
বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে অন্যদের গুণকীর্তন সম্ভব!
ছাত্রজীবন থেকে জনগণের কাছে আমি একটা নীতি-আদর্শের কথা বলে এসেছি। সেখানে আমি কি বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে জিয়া, এরশাদ ও খালেদার গুণকীর্তন করতে পারি! সেটাই যদি হতো, তাহলে আমি কী ধরনের মানুষ? কিন্তু বর্তমানের বাস্তবতা অনেকটাই বদলে গেছে। কেউ কেউ আজ আওয়ামী লীগ, কাল বিএনপি, পরশু জাতীয় পার্টি করছে। গুণকীর্তন করছে শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও এইচ এম এরশাদের। এমন মানুষের অভাব নেই। তাঁরা শুধু ক্ষমতা চান। ক্ষমতার ভাগ চান। একটা কিছু হতে চান। অথচ জনগণের কল্যাণের জন্য কিছু করতে চাইলে এমনটা হওয়ার কথা ছিল না।’
মানুষই মূল শক্তি
এ দেশের মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে রাজনীতি করার জন্য দল-মত নির্বিশেষে সব রাজনীতিবিদকে পরামর্শ দিয়েছেন সদ্য বিদায়ী রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, তাহলে রাজনীতি আরও অনেক সুন্দর হবে।
আবদুল হামিদ বলেছেন, মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষকে সম্মান করতে হবে। মানুষকে তিনি মানুষ হিসেবেই দেখেছেন। জীবনভর মানুষকেই ভালোবেসেছেন। কে শিক্ষিত, কে অশিক্ষিত– এটা কখনোই তাঁর কাছে বিবেচ্য নয়। মানুষই তাঁর মূল শক্তি। স্বার্থের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে মানুষকে ভালোবাসলে হবে না। কৃত্রিমতা বা অন্য উদ্দেশ্য থাকলে মানুষের ভালোবাসা পাওয়া যাবে না। আর সত্যিকার অর্থে ভালোবাসলে মানুষের ভালোবাসা অবশ্যই পাওয়া যাবে।
প্রাণ খুলে কথা বলতে না পারার অতৃপ্তি
রাষ্ট্রপতি থাকাকালে মানুষের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতে না পারার অতৃপ্তিও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত আবদুল হামিদের। তিনি বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে পারতাম না। কিশোরগঞ্জে নিজের বাড়িতে গেলে ঘরের নিজস্ব লোকজনের সঙ্গেও স্বাভাবিকভাবে কথা বলা যেত না। সাধারণ মানুষ কথা বলতে সংকোচ বোধ করতেন। আমিও স্বস্তি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না। অথচ আগে সবার ঘরে ঘরে গিয়ে জানতে চাইতাম, কী খবর? কী রান্না করেছেন? কিন্তু রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তা আর সম্ভব হয়নি।’
নতুনের কাছে প্রত্যাশা
নতুন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন সাংবিধানিক দায়িত্ব সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পালন করবেন– এটাই প্রত্যাশা করছেন সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। তিনি বলেছেন, দেশ ও জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী নতুন রাষ্ট্রপতি সার্বিকভাবে জনগণের কল্যাণে কাজ করবেন।
স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন শেখ হাসিনা
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন আবদুল হামিদের পছন্দের একমাত্র রাজনীতিক। তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধুই। বঙ্গবন্ধুর পর তাঁর কোনো পছন্দের রাজনীতিক নেই। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর কন্যা। এটা তাঁর কাছে বিশেষ কিছু। বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলেই রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অনেক ভালো। তিনি (শেখ হাসিনা) তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন। শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা বঙ্গবন্ধুর কন্যা বলেই তাঁর সঙ্গেও সুসম্পর্ক রয়েছে।
আমি খুশি, আমি সুখী, আমি আত্মতৃপ্ত
মোঃ আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘আমি দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞ। তাঁরা আমাকে সমর্থন দিয়েছেন। আমি তাঁদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। তাঁদের ভালোবাসা পেয়েছি। আমিও আন্তরিকভাবে মনেপ্রাণে তাঁদের ভালোবেসেছি। জনগণের কাছ থেকে আমি এর প্রতিদানও পেয়েছি। সব মিলিয়ে আমি খুশি, আমি সুখী, আমি আত্মতৃপ্ত।’
COMMENTS