ইউরোপে অভিবাসনের উদ্দেশ্যে ছোট নৌকা বা ভেলায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়াকে বলা হয় বোট মাইগ্রেশন। আর এভাবে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা পরিচিত ‘বোট পিপল’...
ইউরোপে অভিবাসনের উদ্দেশ্যে ছোট নৌকা বা ভেলায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়াকে বলা হয় বোট মাইগ্রেশন। আর এভাবে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা পরিচিত ‘বোট পিপল’ হিসেবে। বিপত্সংকুল এ পন্থায় গত বছর ইতালিতে পৌঁছেছেন ১৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশী। অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ এ উপায়ে অভিবাসী গমন ঠেকাতে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। এর পরও ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ইউরোপীয় দেশগুলোয় বাংলাদেশী বোট পিপল গমনের সংখ্যা কমছে না। বরং গত বছর শুধু ইতালিতেই বাংলাদেশী বোট পিপল গমনের হার বেড়েছে ৯৪ শতাংশের বেশি।
ইতালিতে বাংলাদেশীদের ভূমধ্যসাগরীয় রুটে অবৈধ অভিবাসন নিয়ে মার্চে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম)। ‘মাইগ্রেশন ফ্রম বাংলাদেশ টু ইতালি ভায়া লিবিয়া’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে উঠে আসে, এ পথ পাড়ি দেয়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে বাংলাদেশীর হার এখন দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। ২০১৯ সালেও এমন অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে বাংলাদেশীর হার ছিল ৬ শতাংশ। ২০২১ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ শতাংশে। প্রায় দ্বিগুণ হয়ে এ হার গত বছর শেষে দাঁড়িয়েছে ১৯ শতাংশে।
বর্তমানে ইতালিতে সমুদ্রপথে অবৈধ অভিবাসনের সবচেয়ে বড় ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে উঠেছে আফ্রিকার গৃহযুদ্ধ বিপর্যস্ত দেশ লিবিয়া। অভিবাসনপ্রত্যাশীরা শুরুতে দেশটিতে পাড়ি জমাচ্ছেন তুরস্ক, মিসর বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ হয়ে। এর পর সেখান থেকে নৌকায় করে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ ভূমধ্যসাগরের ওপর দিয়ে রওনা দিচ্ছেন ইতালির দিকে। আইওএমের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইতালিতে এ পথ ধরে প্রবেশ করেছেন ১৫ হাজার ২২৮ বাংলাদেশী। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৮২৮। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে ইতালিতে বাংলাদেশী বোট পিপল গমনের সংখ্যা বেড়েছে ৯৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। বর্তমানে ইতালিমুখী বোট পিপলের উৎস দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।
এসব বাংলাদেশীর অধিকাংশই পূর্বাঞ্চলীয় ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোর বাসিন্দা। বিশেষ করে কুমিল্লা, নোয়াখালী, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, হবিগঞ্জ, সিলেট ও মৌলভীবাজারের অনেক বাসিন্দা এখন লিবিয়া উপকূল ধরে নৌপথে ইউরোপের উদ্দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এর বাইরেও তাদের মধ্যে বড় একটি অংশ আসে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা যশোর থেকে।
লিবিয়া থেকে ইতালি পর্যন্ত রুটে ভূমধ্যসাগরের অংশটি তুলনামূলক বেশি ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ। ঝুঁকিপূর্ণ এ পথটি পাড়ি দিতে প্রায়ই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে অভিবাসন প্রত্যাশীদের বহনকারী নৌকা বা ভেলা। সর্বশেষ গত মার্চেও লিবিয়া ছেড়ে আসা ইতালিমুখী একটি নৌকা উল্টে যায়। নৌকার ৩০ আরোহীর মধ্যে ১৭ জনই ছিলেন বাংলাদেশী।
প্রতিনিয়ত এসব দুর্ঘটনার খবর সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম হলেও এ পথে বাংলাদেশীদের ইতালি গমন থামানো যাচ্ছে না। অভিবাসন প্রত্যাশীরা বলছেন, মূলত ইউরোপীয় দেশগুলোয় উজ্জ্বল ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার স্বপ্ন থেকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ পথে পা বাড়াচ্ছেন বাংলাদেশী তরুণরা। এছাড়া মানব পাচারকারী ও দালালদের প্রলোভনও এখানে অনেক বড় ভূমিকা রাখছে।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) নির্বাহী পরিচালক সিআর আবরার এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মানুষের যাওয়ার তাগিদ তো আছেই। এগুলো একটা সংঘবদ্ধ চক্রের কাজ। পশ্চিমা দেশগুলোয় সুযোগের স্বপ্ন বিক্রি করার মানুষ আছে এবং ক্রমাগত তারা সংঘবদ্ধ হচ্ছে। মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনা ঘটলে কিছু তত্পরতা দেখা যায়। কিন্তু তা আবার বন্ধ হয়ে যায়। এটা কেন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা যাচ্ছে না সেটাই প্রশ্ন। বিষয়টিকে অগ্রাধিকারেও রাখা হচ্ছে না। এ সমস্যার সমাধানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। অনেক মানুষ এভাবে পাড়ি দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছে। একটা পরিবারের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে। যারা অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত তাদের নিয়ন্ত্রণ করা তেমন বড় কোনো বিষয় নয়। এক্ষেত্রে সরকারকেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সক্ষমতা নিয়ে এখন কারো মনে কোনো প্রশ্ন নেই। এক্ষেত্রে গুরুত্ব দেয়া হলে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। অনেকে মধ্যপ্রাচ্য থেকেও যাচ্ছে, যারা আগে থেকেই সেখানে অবস্থান করছিলেন।’
বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, লিবিয়া ইতালিতে বোট মাইগ্রেশনের ট্রানজিট পয়েন্ট হয়ে ওঠে ২০১০ সালের দিকে। সে সময় অনেক বাংলাদেশী কর্মী লিবিয়ার বিভিন্ন খাতে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু দেশটির গৃহযুদ্ধ তাদের কর্মসংস্থানে আঘাত হানে। ফেরত আসতে শুরু করেন বাংলাদেশী কর্মীরা। বড় একটি অংশ আটকা পড়েন। প্রথমদিকে মূলত তারাই যেকোনো উপায়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেন। তাদের হাত ধরেই লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাত্রার বিষয়টির সূত্রপাত ঘটে। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় মানব পাচার চক্র। বাংলাদেশ থেকে উন্নত জীবনের খোঁজে থাকা ও বেকার তরুণদের চুক্তির ভিত্তিতে ইউরোপে নিয়ে যেতে শুরু করে তারা। অনেকে ধরা পড়েন। অনেকের মৃত্যু হয়। অল্প কিছুসংখ্যক ইতালি পৌঁছতে সমর্থ হন। এ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ধারণা থাকে, কোনোভাবে ইতালি পৌঁছতে পারলেই এক পর্যায়ে বৈধতা পাওয়া যাবে। যদিও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে স্বাক্ষরিত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরসের (এসওপি) আওতায় অবৈধ অভিবাসীদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা রয়েছে। আবার দেশটির বর্তমান সরকারও অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে কট্টর অবস্থান গ্রহণ করেছে।
সম্প্রতি সমুদ্রপথে অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ইতালি সরকার নতুন একটি আইন প্রণয়ন করে। আইনে অবৈধ অভিবাসন ও মানব পাচারের সঙ্গে জড়িতদের ১০ থেকে ৩০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আবার যেসব নৌকায় করে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিচ্ছে, সেগুলোর চালকদের জন্যও একই সাজার বিধান রাখা হয়েছে আইনে।
আইওএমের প্রতিবেদনে উঠে আসে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার উদ্দেশ্যে ২০২২ সালের শেষে লিবিয়ায় এসে জড়ো হওয়া বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৬৫৩। এছাড়া গত বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে না পেরে লিবিয়ায় ফেরত গেছে আরো ৪ হাজার ৪৪৮ বাংলাদেশী। বছরজুড়ে আটকের পর দেশটির বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হয়েছে দুই হাজারের বেশি বাংলাদেশীকে।
লিবিয়ায় অবস্থানকালে বাংলাদেশীদের অনেক নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে দিন পার করতে হয়। তাদের নিরাপদে দেশে ফেরাতে ভলান্টারি হিউম্যানিটারিয়ান রিটার্ন (ভিএইচআর) শীর্ষক এক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে আইওএম লিবিয়া। এর আওতায় লিবিয়া থেকে ২০২২ সালে ১ হাজার ১০২ জনকে দেশে ফেরানো হয়েছে। আগের বছর ফেরানো হয়েছিল ৮১৫ অভিবাসীকে।
আইওএমের পক্ষ থেকে গত বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ার উদ্দেশ্যে লিবিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশীদের ওপর এক জরিপ চালানো হয়। জরিপে ৫৭ শতাংশ জানিয়েছে, তারা দেশটিতে এসেছেন দল বেঁধে। আবার এ দলবদ্ধ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে ৪১ শতাংশ এসেছে পরিবার বা আত্মীয়-স্বজন সঙ্গে করে। বাংলাদেশীদের প্রায় সবাই জানিয়েছেন, তাদের সবাই লিবিয়ায় প্রবেশ করেছেন আনুষ্ঠানিক রুটে বা বৈধ পন্থায়। লিবিয়ায় অবস্থানরত ইউরোপে অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশীদের এক-তৃতীয়াংশ সেখানে গেছে তুরস্ক হয়ে। ৩৮ শতাংশ গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) হয়ে। মিসর হয়ে গেছে ১৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া পর্যন্ত যেতে এ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের খরচ হয়েছে ৪৫০ থেকে ৪ হাজার ৮৮৯ ডলার। মূলত রুট ও পরিবহনের ওপর নির্ভর করে এ ব্যয় নির্ধারণ হয়েছে। আবার লিবিয়া থেকে নৌপথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে মাথাপিছু খরচ পড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার ডলার। সে অনুযায়ী, একজন অভিবাসন প্রত্যাশীর বাংলাদেশ থেকে লিবিয়া হয়ে ইতালি পর্যন্ত পৌঁছতে খরচ পড়ে মাথাপিছু ৮ হাজার ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকার সমপরিমাণ)।
সার্বিক বিষয়ে জানতে আইওএম বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাত্ক্ষণিকভাবে তাদের কোনো মন্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।~বনিক বার্তা
COMMENTS